বন্যার হতে রক্ষার উপায়। বন্যা অবস্থায় কী কী করণীয়? বন্যা কেন হয়?

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, এবং এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রকৃতির কারণে প্রায়ই বন্যার সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের বন্যা ঘটে: নদীর বন্যা, বর্ষার বন্যা, এবং ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা হঠাৎ বন্যা। আমরা আজকে আরোচনা করবো বন্যার হতে রক্ষার উপায়। বন্যা অবস্থায় কী কী করণীয়? বন্যা কেন হয়? বাংলাদেশে বন্যা হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ভারতের বেরিবাধ। তাদের এলাকা থেকে আমাদের দেশে পানি প্রবেশ করার জন্য বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের বন্যা একটি বার্ষিক সমস্যা হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। 

বন্যার হতে রক্ষার উপায়। বন্যা অবস্থায় কী কী করণীয় বন্যা কেন হয়

বাংলাদেশ সরকার বন্যা প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বাঁধ নির্মাণ, নদীর গভীরতা বাড়ানো, বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থা উন্নত করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও বন্যা ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে নদীর বন্যা প্রধানত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর কারণে ঘটে। বর্ষার মৌসুমে এই নদীগুলোর পানি বেড়ে যায় এবং নদীর তীর উপচে পড়ে। প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে বর্ষার সময় বিভিন্ন অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যা বর্ষার বন্যা হিসেবে পরিচিত। এই ধরনের বন্যা সাধারণত সল্প-স্থায়ী হয় কিন্তু অনেক ক্ষতি করতে পারে। ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা হঠাৎ বন্যা এই ধরনের বন্যা পাহাড়ি এলাকায় ঘটে এবং অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্টি হয়। এটি হঠাৎ করে আসে এবং প্রায়শই মানুষের জীবন ও সম্পদের বড় ধরনের ক্ষতি করে।  বাংলাদেশের বন্যা সাধারণত ফসল, বাড়িঘর, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি করে। কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতি বন্যার প্রভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও খাদ্য সংকট জনজীবনে ব্যাপক দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। তাহলে চলুন জেনে নি বন্যার হতে রক্ষার উপায়। বন্যা অবস্থায় কী কী করণীয়? বন্যা কেন হয়?


বাংলাদেশে বন্যার সমস্যা একটি দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুতর সমস্যা যা নানা কারণে ঘটে। দেশের ভৌগলিক অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের কার্যকলাপ এই সমস্যার জন্য দায়ী। এখানে বাংলাদেশে বন্যার সমস্যা সংক্রান্ত কিছু মূল বিষয় তুলে ধরা হলো-


ভৌগলিক অবস্থানঃ বাংলাদেশ একটি নিম্নভূমি দেশ, যা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদী অববাহিকার মিলনস্থলে অবস্থিত। এই কারণে বর্ষাকালে প্রবাহিত জল বিপুল পরিমাণে বেড়ে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।


মৌসুমী বৃষ্টিঃ বর্ষাকালে, মৌসুমী বৃষ্টির কারণে নদীগুলোর পানি স্তর বৃদ্ধি পায়, যা বন্যার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, উজানে ভারী বৃষ্টি হলে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং নিম্নভূমি এলাকায় জল জমে যায়।


জলবায়ু পরিবর্তনঃ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, যা গ্লেসিয়ার গলে যাওয়ার মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার সমস্যা বাড়ছে।

ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনঃ নদীর তীরবর্তী জমি ভরাট করা, বনভূমি কাটা এবং কৃষি জমির উপর নির্মাণের কারণে নদীগুলোর প্রবাহের পথ পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর ফলে বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে।


অপরিকল্পিত নগরায়ণঃ অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বর্ধিত শহুরে এলাকা নদীগুলোর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে বন্যা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।


পানির প্রবাহ ব্যবস্থাপনার অভাবঃ পুরনো স্লুইস গেট, বাঁধ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্যার পানি নিষ্কাশনে পর্যাপ্ত নয়। জলাধার ও নদী খনন বা সংস্কার না করার কারণে সমস্যা আরও বাড়ে।


সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবঃ বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়: কৃষি জমি পানিতে ডুবে যায়, ঘর-বাড়ি, রাস্তা ও অন্যান্য অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি, জীবনযাত্রার মান কমে যায় এবং স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।


বন্যার মোকাবিলাঃ

  • বাঁধ ও সুইচ গেট নির্মাণ- নদী ও খালের পাশে বাঁধ নির্মাণ এবং স্লুইস গেটের সংস্কার।
  • প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা- বনাঞ্চল রক্ষা ও নতুন বন তৈরি।
  • বন্যা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা- উন্নত আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরণ ব্যবস্থা।
  • অভ্যন্তরীণ অভ্যন্তরীণ পুনর্বাসন- ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য পরিকল্পনা ও সহায়তা।
  • সামাজিক সচেতনতা- জনগণকে বন্যা প্রতিরোধ এবং প্রস্তুতির জন্য সচেতন করা।


বাংলাদেশে বন্যা মোকাবেলা করার জন্য সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ, বেসরকারি সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সহায়তা প্রয়োজন।



বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় রয়েছে যা আপনি অনুসরণ করতে পারেন:


তথ্য সংগ্রহঃ বন্যার পূর্বাভাস এবং সতর্কতা বার্তাগুলি নিয়মিতভাবে অনুসরণ করুন। আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য এবং স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলুন। পাশাপাশি বন্যা সংক্রান্ত সকল তথ্য সম্পর্কে যোগাযোগ রাখা। 


ইমারজেন্সি কিট প্রস্তুত রাখুনঃ আপনার কাছে প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন খাবার, পানি, ঔষধ, ফার্স্ট এইড কিট, এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র সমন্বিত একটি ইমারজেন্সি কিট রাখুন। যাতে করে বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন। কেননা বন্যা প্লবতি এলাকায় শারিরীক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সেবার জন্য এসব রাখা অত্যান্ত জরুরি। 

বন্যা প্রতিরোধী নির্মাণঃ বাড়ি এবং অন্যান্য নির্মাণ স্থানের উঁচু স্থানে অবস্থান করা এবং বন্যার পানি প্রবাহের জায়গা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। তাছাড়া বিভিন্ন বেরিবাধ নির্মান করতে হবে। যাতে করে পানি প্রবেশ করে নিজের ঘরবাড়ি বা আসবাবপত্র নষ্ট না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বন্যা পূর্বভাসের সাথে সাথে আপনাকে অবশ্যই আশ্রয়ই স্থানে প্রবেশ করতে হবে। তাছাড়া আপনার বাসার গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। আপনার পরিবারের জন্য একটি সুরক্ষা পরিকল্পনা প্রস্তুত করুন। কোথায় যেতে হবে, কিভাবে যোগাযোগ করবেন, এবং কীভাবে নিরাপদে স্থানান্তরিত হবেন তা নির্ধারণ করুন।


নিরাপত্তার ব্যবস্থাঃ বন্যার সময় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকুন। বাড়ির চারপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করুন এবং পানি প্রবাহের পথ নিশ্চিত করুন যাতে পানির সঞ্চয় কম হয়। বাড়ির মেঝে উঁচু করে রাখুন অথবা বন্যার পানির স্তরের উচ্চতা অনুযায়ী নির্মাণ করুন।

বন্যার পরে করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ

সুরক্ষা নিশ্চিত করুনঃ প্রথমে নিশ্চিত করুন যে আপনার এবং আপনার পরিবারের সবার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আহত বা অসুস্থদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিন এবং প্রয়োজনে মেডিকেল সহায়তা পান।

পরিবেশ পরিস্কার করুনঃ পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি, রাস্তা ও অন্যান্য স্থানে জমে থাকা ময়লা ও কাদা পরিষ্কার করুন। এই ধরনের অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া ও রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

বাড়ির নিরাপত্তা পরীক্ষা করুনঃ ভবনের কাঠামো ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করুন। দেয়াল, ছাদ এবং অন্যান্য স্থাপনায় কোনো ফাটল বা ক্ষতি হয়েছে কিনা তা দেখুন।

পানির নিরাপত্তাঃ পানি ব্যবহারের আগে পরীক্ষা করুন। বন্যার পানি পিপাসা মেটানোর জন্য উপযুক্ত নয়। নিরাপদ পানি পান করুন এবং খাবারও সতর্কতার সাথে গ্রহণ করুন।

ফেরত যাওয়ার পরিকল্পনা করুনঃ যদি আপনার জায়গা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়ে থাকে, তবে ফেরত যাওয়ার আগে নিশ্চিত করুন যে জায়গাটি নিরাপদ এবং ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।

মুসলিম সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপের সহায়তাঃ বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপের মাধ্যমে সহায়তা গ্রহণ করুন। তারা খাদ্য, পোশাক এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান করতে পারে।

সরকারী নির্দেশনা মেনে চলুনঃ স্থানীয় প্রশাসন এবং অন্যান্য সরকারী সংস্থার নির্দেশনা মেনে চলুন এবং কোনো জরুরি পরামর্শ বা নির্দেশনা অনুসরণ করুন।

নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণের পরিকল্পনা করুনঃ ভবনের মেরামত এবং নতুন করে কাজ শুরু করার আগে যেকোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হন।

এছাড়া, বন্যার প্রভাব সামাল দিতে প্রস্তুতি নেওয়া এবং ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা গুরুত্বপূর্ণ।


প্রিয় পাঠক আমাদের আজকের বিষয় ছিলো বন্যার হতে রক্ষার উপায়। বন্যা অবস্থায় কী কী করণীয়? বন্যা কেন হয়? এতক্ষণ আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আরও অনেক বিষয়ে তথ্য পেতে আমাদের নিয়মিত ফলো করুন।

Next Post Previous Post